ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তিনি গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্ডানে স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা অঞ্চলের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। তবে কিছু ইসরায়েলি নেতা আগে থেকেই ট্রাম্পের এই বক্তব্য সম্পর্কে জানতেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ট্রাম্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাজা সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং এর বাসিন্দাদের মিসর ও জর্ডানে "স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী" স্থানান্তরের পর গাজাকে পুনর্নির্মাণ করা উচিত। যদিও জর্ডান ও মিসর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে, তবুও ট্রাম্প তার বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং গাজাবাসীকে স্থানান্তরের জন্য মিসর, জর্ডান ও অন্যান্য পক্ষকে এই প্রকল্পে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য কোনো অসতর্ক মন্তব্য নয়, বরং এটি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার সহযোগীদের গোপন পরিকল্পনারই প্রকাশ। নেতানিয়াহু ও তার দল গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, যদিও তারা প্রকাশ্যে এই প্রস্তাব নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, যাতে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ না ওঠে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে জো বাইডেনও গোপনে মিসরের উপর গাজাবাসীদের সিনাই উপদ্বীপে স্থানান্তরের জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। সেই আলোচনায় মিসরের বিদেশী ঋণ মওকুফের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। তবে মিসর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং গাজাবাসীদের স্থানান্তরের পথ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। ইসরায়েলি নেতৃত্বের মধ্যে এই নিয়ে বিতর্ক হয়, যেখানে কেউ কেউ মিসরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেও গাজাবাসীদের বাস্তুচ্যুত করার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু নেতানিয়াহু মিসরের সাথে সম্পর্কের অবনতির ভয়ে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে ইতস্তত করেন।
ইসরায়েলের চরম ডানপন্থী নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও জর্ডান, মিসর ও ফিলিস্তিনিদের কঠোর বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েলি নেতৃত্বের মধ্যে এই নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কেউ কেউ যেকোনো মূল্যে গাজাবাসীদের তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তুচ্যুত করার পক্ষে, আবার কেউ কেউ অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে চাইছেন।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাব ইসরায়েলি "ট্রান্সফার" নীতিরই প্রতিফলন। এই নীতি অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিদের "স্বেচ্ছায়" স্থানান্তরের নামে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হয়, যাতে তারা নিজেদের ভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ইসরায়েলি নেতারা মনে করেন, গাজাকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হলে ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় চলে যেতে বাধ্য হবে।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাব নতুন নয়, বরং এটি ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও জায়নবাদী আন্দোলনের সময় থেকেই চলে আসছে। জায়নবাদী নেতারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের নকবায় (ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতকরণ) এই নীতিই কার্যকর করা হয়েছিল। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটও ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পর অনেকেই এটিকে গুরুত্বহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এটি ইসরায়েলি পরিকল্পনারই অংশ। ইসরায়েল ফিলিস্তিনে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার নামে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা করছে। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পেছনেও এই লক্ষ্য কাজ করছে।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন রোধ করতে মিসর, জর্ডান ও ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থান অপরিহার্য। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করতে পারে। তাই ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলি ও আমেরিকান এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জরুরি।
ট্রাম্পের গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার প্রস্তাব ইসরায়েলি পরিকল্পনারই প্রতিফলন। মিসর, জর্ডান ও ফিলিস্তিনিদের কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসরায়েল এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি।