সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল (Supermassive Black Hole) হল মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় এবং শক্তিশালী বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। এদের ভর সূর্যের ভরের লক্ষ গুণ থেকে শুরু করে কোটি কোটি গুণ পর্যন্ত হতে পারে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে জন মিচেল এবং পিয়ের-সিমন লাплаাস ধারণা দেন যে এমন বস্তু থাকতে পারে যাদের মহাকর্ষ এতই শক্তিশালী যে আলোও সেখান থেকে পালাতে পারবে না। তবে তখন একে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই তত্ত্ব মহাকর্ষকে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে ব্যাখ্যা করে এবং ব্ল্যাক হোলের ধারণাটিকে একটি শক্ত ভিত্তি দেয়।
১৯১৬ সালে কার্ল শোয়ার্জশিল্ড আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি গাণিতিক সমাধান বের করেন, যা ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের প্রথম গাণিতিক প্রমাণ দেয়। এই সমাধান অনুযায়ী, কোনো বস্তুকে একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের মধ্যে সংকুচিত করলে তা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। এই ব্যাসার্ধকে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ বলা হয়।
১৯৩০-এর দশকে ভারতীয় পদার্থবিদ সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর নক্ষত্রের বিবর্তন নিয়ে কাজ করার সময় দেখান যে একটি নির্দিষ্ট ভরের বেশি ভরের নক্ষত্র নিজের মহাকর্ষের টানে চুপসে গিয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে পারে। জন হুইলার ১৯৬৭ সালে প্রথম “ব্ল্যাক হোল” নামটি ব্যবহার করেন।
১৯৭০-এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা X-ray উৎস Cygnus X-1 থেকে আসা বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করেন এবং সিদ্ধান্তে আসেন যে এটি একটি ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি নির্দেশ করে। এটিই ছিল প্রথম জোরালো পর্যবেক্ষণ যা ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত Sagittarius A* একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। এর অস্তিত্ব বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল এর চারপাশে নক্ষত্রদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ।
২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (Event Horizon Telescope) প্রথমবারের মতো ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। এই ছবিটি M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ছিল।
নিচে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে কিছু আশ্চর্যজনক তথ্য দেওয়া হলো:
প্রায় সকল বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এদের অবস্থান:
বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে প্রায় প্রতিটি বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি করে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল রয়েছে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও Sagittarius A* নামের একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল আছে।
এদের ভর সূর্যের ভরের লক্ষ গুণ থেকে শুরু করে কোটি কোটি গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এই বিপুল ভরের কারণে এদের মহাকর্ষীয় টান অত্যন্ত শক্তিশালী হয়।
ব্ল্যাক হোলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্যাস ও ধূলিকণার একটি ডিস্ক থাকে, যাকে অ্যাক্রিশন ডিস্ক বলে। এই ডিস্কের পদার্থ ব্ল্যাক হোলের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার সময় প্রচণ্ড গতিতে ঘোরে এবং তাপে উত্তপ্ত হয়ে আলো বিকিরণ করে।
কিছু সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল অত্যন্ত সক্রিয় থাকে এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করে। এই অবস্থায় এদের কোয়াসার বলা হয়। কোয়াসারগুলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কিছু সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল থেকে আলোর গতির কাছাকাছি বেগে পদার্থ নির্গত হয়, যা জেট নামে পরিচিত। এই জেটগুলো লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের শক্তিশালী মহাকর্ষের কারণে স্পেস-টাইম বেঁকে যায়। এর ফলে আলোকরশ্মি পর্যন্ত তাদের পথ পরিবর্তন করে।
যখন দুটি গ্যালাক্সি মিলিত হয়, তখন তাদের কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলোও একত্রীভূত হতে পারে। এই ঘটনা মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি।
সরাসরি ব্ল্যাক হোল দেখা সম্ভব নয়, কারণ তারা আলোও শোষণ করে নেয়। তবে তাদের চারপাশের বস্তুর গতি এবং বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়।
সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলো গ্যালাক্সির গঠন এবং বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের সম্পর্কে আরও অনেক রহস্য এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে, যা বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্যতম প্রধান বিষয়।